শনিবার, ৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২১শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অকাল প্রয়াত এস এ শাহরিয়ার রিপন স্মরণে: তালাত মাহমুদ

শেরপুরের সন্তান আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত সৌখিন আলোকচিত্রশিল্পী এসএ শাহরিয়ার রিপন এর অকাল মৃত্যুতে স্মরণ সভা ও দোওয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে শেরপুর সাংস্কৃতিক সংসদ। ৫ আগস্ট বুধবার বিকেলে শেরপুর পৌর টাউন হল মিলনায়তনে শেরপুর সাংস্কৃতিক সংসদের সভাপতি ও শেরপুর পৌরসভার মেয়র মানবিক ব্যক্তিত্ব আলহাজ গোলাম মোহাম্মদ কিবরিয়ার সভাপতিত্বে স্মরণ সভা ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। সাংস্কৃতিক সংসদের সাধারণ সম্পাদক সারোয়ার জাহান তপনের পরিচালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন শেরপুর জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি আলহাজ ফখরুল মজিদ খোকন, সমাজ সেবিকা রাজিয়া সামাদ ডালিয়া, অধ্যাপক শিব শংকর কারুয়া, শেরপুর জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট সুব্রত কুমার দে ভানু, শেরপুর জেলা আওয়ামীলীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক আনিসুর রহমান, শেরপুর জেলা ফ্টুবল এসোসিয়েশনের সভাপতি মানিক দত্ত, আলহাজ শফিউল আলম চাঁন ও এসএ শাহরিয়ার রিপনের পতœী তানিয়া। আলোচনা শেষে মরহুমের আত্মার শান্তি কামনায় বিশেষ মুনাজাত করা হয়। উল্লেখ্য, গত ৪ জুলাই ২০২০ দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এসএ শাহরিয়ার রিপন মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়েস হয়েছিল ৫৩ বছর।
শেরপুর পৌর টাউন হল মিলনায়তনে একটি স্মরণ সভায় আমাকে যোগ দেওয়ার জন্য পৌরসভা থেকে একজন মহিলা মোবাইলে আমন্ত্রন জানিয়েছিলেন। কার স্মরণ সভা, বিষয়টি পরিস্কার করে বোঝার আগেই মহিলাটি মোবাইলের লাইন কেটে দেন। শুধু বলেছিলাম, আমি অসুস্থ। যেতে পারবো কি’না বলতে পারছি না। তবে এসএ শাহরিয়ার রিপনের স্মরণ সভা উল্লেখ করলে অবশ্য অবশ্যই আমি অসুস্থ শরীর নিয়েই স্মরণ সভায় যোগ দিতাম।্
এসএ শাহরিয়ার রিপন আর আমি সম্পর্কে মামা ভগ্নে। এডভোকেট আফতাবউদ্দিন আহমেদ ছিলেন শেরপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান। তাঁরই সুযোগ্য পুত্র এডভোকেট আমিনুল ইসলাম (ইপিসিএস) ও পুত্রবধূ সেলিমা ইসলামের এঁর তিন পুত্র সন্তানের মধ্যে এসএ শাহরিয়ার রিপন ছিলেন দ্বিতীয়। বড়ভাই এডভোকেট এসএ শাহরিয়ার লিটন ও ছোটভাই এসএ শাহরিয়ার মিলটন। তাঁরা তিন ভাই-ই সাংবাদিকতার সাথে জড়িত ছিলেন। এসএ শাহরিয়ার মিলটন এখনো সাংবাদিকতা করছেন। তিনি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘শেরপুর টাইমস’র সম্পাদক।
এসএ শাহরিয়ার রিপনের সাংবাদিকতায় প্রথম হাতে খড়ি আমার মাধ্যমে ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক সফিয়া’য়। সেটা ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দের কথা। আমি তখন সাপ্তাহিক সফিয়া’র সম্পাদক এবং সরকারি আনন্দ মোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের মাস্টার্স-এর ছাত্র। এসএ শাহরিয়ার রিপন অত্যন্ত সাহসী ও বস্তুনিষ্ট সাংবাদিক ছিলেন। শেরপুর তখন মহকুমা। রিপন “হাওয়া থেকে পাওয়া” শিরোনামে এক ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করে সাড়া জাগিয়েছিলেন। এছাড়াও শেরপুর মহিলা কলেজের একটি স্পর্শকাতর রিপোর্ট করেও তিনি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। সে সময় এসএ শাহরিয়ার রিপন আর সৌমিত্র শেখর দের মাঝে একটা প্রতিযোগিতা ছিল। সৌমিত্র শেখর দে তখন সাপ্তাহিক নবজাগরণের সংবাদদাতা ছিলেন আর রিপন সাপ্তাহিক সফিয়া’র। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের স্বত্ব নিয়ে তাদের মাঝে বিরোধ দেখা দিতো।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যে মহীয়সী নারীর নামানুসারে “সাপ্তাহিক সফিয়া” পত্রিকার নামকরণ হয়েছে তিনি ছিলেন আমার মোজো দাদী। শেরপুরের সাবেক গভর্ণর এডভোকেট আনিসুর রহমানের বড় বোন। তিনি রতœগর্ভা ছিলেন। তাঁর ১০ সন্তানের মধ্যে ৮ জনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। তাঁর বড় ছেলে শহীদুল হক (শাহজাহান) চেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। তিনি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর আপন বড় ভায়রা। বড় মেয়ে নার্গিস আনার ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। মেজ ছেলে এএইচএম সাদিকুল হক অতিরিক্ত সচিব ছিলেন। দ্বিতীয় মেয়ে নজরুল সঙ্গীত শিল্পী ফেরদৌস পারভীন উপ-সচিব ছিলেন। তৃতীয় ছেলে আজম ফারুক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্ত চলচ্চিত্র নির্মাতা ও অভিনেতা, চতুর্থ ছেলে শফিকুল হাসান বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের উপ-পরিচালক ছিলেন এবং চতুর্থ মেয়ে নাসরিন পারভীন বর্তমানে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পরিচারক (পার্সনাল)। অন্যান্য সন্তানরাও স্ব স্ব ক্ষেত্রে কর্মদক্ষতার ছাপ রেখেছেন।
প্রিয় পাঠক, মূল লেখায় চলে আসি, এসএ শাহরিয়ার রিপন ছোটবেলা থেকেই ভদ্র ন¤্র এবং সাংগঠনিক ভাবে গড়ে উঠেছিলেন। শেরপুরে এক সময় তিনি কচিকাঁচা মেলার পরিচালক ছিলেন। দৈনিক বাংলা পত্রিকায় কিছুদিন কাজ করেছেন। রিপন অল্প বয়েসে ঢাকায় চলে যান। সৌখিন আলোকচিত্র শিল্পী হিসেবে তিনি বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন। নেপাল ও মালয়েশিয়া সহ বেশ কয়েকটি দেশে তাঁর আলোকচিত্র প্রদর্শনী হয়েছে। তিনি বাংলাদেশ ফটোগ্রাফী সোসাইটিরও সদস্য ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি কবিতা লিখতেন। তাঁর বিজ্ঞাপনী সংস্থার নাম “টুগেদার কমিউনিকেশন”। তিনি এপার্টমেন্ট কোম্পানী শেলটেক গ্রæপ অব কোম্পানীজের উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানে অনেক দান করতেন।
এসএ শাহরিয়ার রিপনকে শেরপুরের এই প্রজন্ম হয়তো চিনবে না। যারা তাঁর নিকট থেকে উপকৃত হয়েছেন তারাই বলতে পারবেন তিনি কেমন মানুষ ছিলেন। চাল চলনে ধীর স্থির, মেপে মেপে কথা বলা, আন্তরিকতা, সৌজন্যবোধ আর তাঁর মার্জিত রুচিশীলতা যে কোন মানুষকে আকৃষ্ট করতো। শেরপুর তেরাবাজার জামিয়া সিদ্দিকিয়া মাদ্রাসা মাঠে রিপনের জানাজায় বিভিন্ন বক্তা তাঁর সম্পর্কে যেসব কথা বলেছেন, শুনে অবাক হয়েছি। রাজধানী ঢাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেও শেরপুরের প্রতি তার যে টান ছিল, শেরপুরের মানুষের সেবা করার যে মনোবৃত্তি ছিল তা কখনোই বুঝার উপায় ছিলনা।কারণ, তিনি আত্ম প্রচার করে দান করতেন না।
আমরা একজন মেধাবী ও মননশীল মানুষকে হারালাম। তাঁর মৃত্যুতে শুধু তাঁর পরিবারই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। প্রকান্তরে শেরপুরের উপকারভোগী মানুষেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কালের আবর্তে সব পিছে পড়ে থাকবে। শুধু কর্মফলটুকু মানুষের মাঝে বিরাজ করবে। কেউ স্মরণ করবে কেউ করবেনা। আর এটাই নিয়ম। সাথে কওে এনেছিলে মৃত্যুহীন প্রাণ/মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।
ঊারবার মনে হচ্ছে, এসএ শাহরিয়ার রিপন অকালে না ফেরার দেশে চলে যাবেন ভাবতে পারিনি। আসলে মৃত্যু কখন কাকে যে আলিঙ্গন করবে বলা মুশকিল। পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন এসএ শাহরিয়ার রিপনকে বেহেস্ত নসিব করেন। আর তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবারকে ধৈর্য ধারণ করার ও শোক সইবার তৌফিকা দেন। আমিন।

লেখক: কবি সাহিত্যিক সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবং সভাপতি, কবি সংঘ বাংলাদেশ।

এই বিভাগের আরো খবর